এহছান খান পাঠান
২০২১ সালে দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার ঐতিহাসিক সাফল্যকে টেকসই করার জন্য নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকে এবং বিশেষত সৌরবিদ্যুৎকে বিদ্যুতের প্রধান উৎসে পরিণত করা সময়ের দাবি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অনেকখানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মারাত্মক ধস নামায় এখন এই বর্ধিত দামে এসব বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানির ব্যাপারে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেকখানি সংকুচিত হয়ে গেছে। প্রায় সাতাশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে এখন ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখতে হচ্ছে। এই সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি, যার পাশাপাশি এখন কয়লানির্ভর মেগাপ্রকল্পগুলোও বড়সড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ‘সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ তাদের ঘোষিত ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপে ৩০,০০০ মেগাওয়াটের সোলার এনার্জির টার্গেট অর্জনের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে ১২,০০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ ছাদভিত্তিক সোলার প্যানেল থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু, এই রোডম্যাপ ঘোষণার পর কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও এই টার্গেট পূরণের উপযুক্ত কর্মসূচি আজও গৃহীত হয়নি। ইচ্ছাকৃত অবহেলার শিকার হয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান, যথাযথ অগ্রাধিকার পায়নি সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য সোর্স থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎকে বিদ্যুতের প্রধান সূত্রে পরিণত করা সময়ের দাবি।
ভোলা গ্যাসের ওপর ভাসছে বলা হলেও ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডে আনার কাজটি এখনো শুরু হয়নি! বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনের অদূরে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমা থেকে পাঁচ টিসিএফের বেশি গ্যাস আহরণ করে চলেছে। একই ভূতাত্ত্বিক কাঠামো যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও রয়েছে তাই বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন এলাকার সমুদ্রেও গ্যাস পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের সোলার পাওয়ারের সাফল্য কীভাবে অর্জিত হয়েছে তা জেনে এ দেশের সোলার-পাওয়ার নীতিকে অবিলম্বে ঢেলে সাজাতে হবে। ২০২০ সালেই ভিয়েতনাম বাড়ির ছাদের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিল। গত তিন বছরে তাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কয়েক হাজার মেগাওয়াট বেড়েছে নিশ্চয়ই। অথচ, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সোলার পাওয়ার উৎপাদন ছিল ৩০০ মেগাওয়াটেরও কম, আর ২০২৩ সালের নভেম্বরেও বাংলাদেশে মাত্র ১১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে নবায়নযোগ্য উৎসগুলো থেকে। গণচীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপাইন এবং জার্মানি ছাদভিত্তিক সোলার পাওয়ার উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে। সোলার প্যানেল ও ‘ব্যাটারি’র দামে সুনির্দিষ্ট ভর্তুকি প্রদান এবং ভর্তুকি-দামে ‘নেট মিটারিং’ স্থাপনে প্রণোদনা প্রদান এসব দেশের সাফল্য অর্জনের প্রধান উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ‘নেট-মিটারিং’ প্রযুক্তি গণচীন থেকে এখন সুলভে আমদানি করা যাচ্ছে। অথচ, এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি একেবারেই নগণ্য রয়ে গেল কেন?
বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলসমূহ, দেশের সমুদ্র-উপকূল এবং নদ-নদী ও খালগুলোর দু’পারে সোলার প্যানেল স্থাপনের সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখা হোক্। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় যে কয়েকশ চরাঞ্চল গড়ে উঠছে সেগুলোতে জনবসতি গড়ে ওঠার আগেই ওগুলোতে যদি বড় বড় সৌরবিদ্যুৎ-কাম-বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা অগ্রাধিকার সহকারে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে অত্যন্ত সাশ্রয়ী পন্থায় কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সম্ভব হবে। বঙ্গোপসাগরে নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলগুলোকে। এগুলোতে মানববসতি নেই, তাই ভূমি অধিগ্রহণের কোনো ঝামেলাই হবে না। উপরন্তু, উৎপাদিত বিদ্যুৎ সাবমেরিন-কেবলের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডের বিদ্যুৎ-গ্রিডে নিয়ে আসাও খুব বেশি ব্যয়সাধ্য হওয়ার কথা নয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই গণচীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে বাংলাদেশি দশ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ১৭ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে দি ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ব্লুমবার্গের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ২০২৫ সালের পর সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অন্য সব বিকল্পের তুলনায় বাংলাদেশেও কমে আসবে। ২০৩০ সালে এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ হবে মাত্র ৪২ ডলার, যেখানে এলএনজিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে তা পড়বে ৯৪ ডলার এবং কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১১৮ ডলার।
এহছান খান পাঠান (নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক অর্থনীতির কাগজ)