এ কে সরকার শাওন :
বিশ্বে এখন চলছে কলি কালের ভাড়ামীর যুগ। কি নাটকে কি চলচ্চিত্রে কি কবিতায় বা গানে সবখানেই ভাড়ামী আর ভাড়ামী। ভাড়ামীতেও মনে হয় পোষাচ্ছে না। সব অশ্লীলতার দিকে চলে যাচ্ছে! বদন বইয়ের ভিডিও ট্যাবে ও ইউটিউবে সহজলভ্য অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। এসবের বিরুদ্ধে কারো কোন জোরালো বক্তব্য দেখিনা। ওখানেও যে ব্যবসা! যেন তেন হলেও তো ব্যবসা। যেখানে ব্যবসা সেখানে চুপ থাকাটা উত্তম। অতি মাত্রায় বাবসায়িক বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম; এখন অনলাইনেও বিজ্ঞাপনের অশেষ যন্ত্রণা। প্রায় সবখানে উদ্ভট বিষয়গুলিকে সামনে আনা হচ্ছে। আর ক্লাসিক্যাল বিষয়গুলো অবহেলিত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পরম্পরা এগুলো তো নির্বাসিত । এর সাথে ব্যবসা জড়িত বলে একদম শেষ হচ্ছে না! অনেক আগে উগান্ডার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি স্লাইড ক্যালিপার্স দেখে প্রধান শিক্ষকের নিকট জানতে চেয়েছিলাম
এই স্লাইড ক্যালিপার্স কি প্রয়োজন এখানে? এখানে তো ক্লাস ফাইভ এর ছাত্র মাতৃভাষায় রিড়িং পড়তে গিয়ে টকশোর দূর্নীতিবাজ আতেলের মত অ্যাঁ অ্যাঁ করে!
“অফিস থেকে দিয়েছে তাই বিনা বাক্যে নিয়ে এসেছি।”
মাথা নিচু করে জবাব দিলেন হেড মাস্টার।
ফেরার পথে গাড়ীতে বন্ধু কবীর আবার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো অনেক টাকা খরচ করে কেনো স্লাইড ক্যালির্পাসটি এই বাচ্চাদরে স্কুলে দিয়েছে? শোন, এই ধরনরে ক্রয় হয়ে থাকে প্রান্তিক ব্যাবহারকারীদের সুবিধা দেয়ার জন্য না। কন্ট্রাকটর, র্কতা ও উপরিওয়ালাদের পকেট ভারী করার জন্যই এই ধরনের আননেসেসারি দামী আইটেম কেনা হয়। মারিং করতে সুবধিা হয়। নীতি বা-নৈতিকতা একবারে তলানীতে ঠেকলে এ রকম ক্রয় হয়। জবাবদিহিতা তো নেই বললেই চলে।
আজকাল বেশির ভাগ নিউজ ওয়েব র্পোটালে কবিতা বা সাহিত্যের ট্যাবটি খুঁজেই পাওয়া যায় না। যে সব দেশে সাহিত্যকে অন্যান্য ট্যাবের মাঝে খুঁজে নিতে হয় সে সব দেশের বদন বইয়ের ভিডিও ট্যাবে টু এক্স, থ্রি এক্স সহজ লভ্য হবইে! পরর্বতী জেনারেশানের শিক্ষার পথ তো লবনাক্ত হয়েই আছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সাহিত্যকে জীবনে গুরুত্বর্পূণ ও অপরিহার্য মনে করনে না। জীবন গঠনের জন্য সাহিত্য পাঠ ও অনুশীলনের বিকল্প নাই। চিন্তা জগতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য, চিন্তা শক্তির বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য, অতীত বা ভবিষৎ বা কল্পনার রাজ্যে ডুব দেবার জন্য, লিখনি শক্তি,বাগ্মিতা গুন বাড়ানোর জন্য, নীতি, নৈতিকতা ও মনোবল বাড়ানোর জন্য সাহিত্যকে গুরুত্ব দিতেই হবে। ব্যক্তি যদি সাহিত্যকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে একসময় ব্যক্তির এতো সাধের জীবনটাই গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। সমাজ ও রাষ্ট্র যদি সাহিত্যকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষয়িষ্ণু হতে বাধ্য।
আমার খুব কাছের ব্যাক্তি রাজশাহী নিউজ ২৪ এর সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার রায়হানুল হক ভাইকে সাহিত্যের গুরুত্বের ব্যাপারে বলার পর তিনি তাঁর ওয়েব পোর্টালে “সাহিত্য” ট্যাব যোগ করে আমাকে কল করে বলেছিলেন, ভাই, আপনার জন্য “সাহিত্য” ট্যাবটি যোগ দিলাম। যারা দেশ ও দশের কথা ভাববে তাঁরা সাহিত্যকে গুরুত্ব দিবেই।
সাহিত্য চর্চা বা পাঠ ছাত্রদের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। সাহিত্য কল্পনা শক্তি, উদ্ভাবনা শক্তি ও সৃজনশীলতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে দেয়। যা সঠিক পরিকল্পনা করতে সহায়তা করে। সাহিত্য কোন একটি বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে থাকে। সহিষ্ণুতা সহানুভুতি ও বোধগম্যতা বাড়িয়ে দেয়। সেইজন্য যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকগণ ও প্রগতির বিপক্ষে অবস্থানকারীরা সাহিত্যকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। সাহিত্য থেকে ছাত্রদের দূরে রাখতে চেষ্টা করে। মাদক, মারামারি, অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দেয়। বিনোদনের সব রকম বাবস্থা করলেও ছল চাতুরী করে সাহত্যি থেকে দূরে রাখে। বন্ধ্যা জাতি তৈরী করে শাসক গোষ্ঠী নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে আজীবন দেশে শাসনের দুঃস্বপ্ন দেখে। কিন্তু তারা জানে না স্বপ্ন দেখতে ও তার বিস্তার ঘটাতে সাহিত্যের বিকল্প নাই। তাছাড়া সাহিত্য সঠিক পথের অনুপ্ররণা ও ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ায়। সাহিত্যের কৌতুক মনে রস-সঞ্চার করে মনকে সতেজ করে, অবসাদ দূর করে।
সাহিত্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমেরিকান সাহিত্যিকে আইলান স্টেভান্স (Ilan Stavans) বলেন, “Literature is the best way to overcome death.” ।
অন্যদিকে রোমান দার্শনিক সিনেকা সাহিত্যহীন জীবনকে মৃত বলে অভিহিত করে বলেছেন, “Leisure without literature is death, or rather the burial of a living man”.
সাহিত্যহীন ব্যস্ত মানুষকে বিপদজনক বলে তাদের থেকে দূরে অবস্থান করতে নির্দেশ প্রদান করে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন,
“Beware the barrenness of a busy life”
সাহিত্যের প্রধান পাঁচটি শাখার (কবিতা, নাটক, গদ্য,নন-ফিকশন ও মিডিয়া) মধ্যে কবিতা অগ্রগণ্য। সাহিত্যের উপরে উল্লেখিত গুনাবলীর বেশীরভাগই কবিতার। গান হচ্ছে গীতি কবিতা। সমাজ পরির্বতনে গান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা ১৯৭১ সালে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। বিশ্বের অনেক জ্ঞানী গুনিজন গান ও কবিতার গুনর্কীতন করে গিয়েছেন।
ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও দার্শনিক উইলিয়াম হ্যাজলিট কবিতাকে বিশ্বজনীন ভাষা বলেছেন এবং যে কবিতাকে ঘৃণা করে সে সম্মান পাওয়ার অযোগ্য বলে তাকে অভিহিত করে বলেছেন,
“Poetry is the universal language which the heart holds with nature and itself. He who has a contempt for poetry, cannot have much respect for himself, or for anything else”.
আমেরিকার ৩৫তম রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি কবিতাকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক বলে অভিহিত করে বলেছেন, “When power leads man toward arrogance, poetry reminds him of his limitations. When power narrows the area of man’s concern, poetry reminds him of the richness and diversity of existence. When power corrupts, poetry cleanses.”
ফ্রান্সিস বেকন কবিকে ধীমান বলেছেন। তিনি বলেছেন, “History makes a man wise.” এরিস্টটল কবিতাকে ইতিহাসের উপরে স্থান দিয়ে বলেছেন, ” Poetry is finer and more philosophical than history; for poetry expresses the universal, and history only the particular.”
আমেরিকান দার্শনিক ও লেখক হেনরী ডেভিড থরীউ কবিতা ও দার্শনকে পাশাপাশি রেখে বলেছেন, কবিতা যেখানে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করে দর্শন করে সেখানে আংশিক সত্য প্রকাশ। তিনি বলেছেন, “Poetry implies the whole truth, philosophy expresses only a particle of it.”.
কবিতা যদি একটি আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনে সবচেয়ে জোরালো বক্তব্য রেখে গিয়েছেন কিংবদন্তী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। জিহবায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কে কবিতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কেও কবিতা বলে কবিতাকে মুকুট পরিয়েছেন। কবিতা যে আদর্শ সমাজের জন্য কত গুরুত্বর্পূণ তা বোঝাতে তিনি বলেছেন,
“যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়রে র্আতনাদ শুনবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।”
লাভ লাভ করতে করতে আমরা টাকার কাছে ক্রীতদাসই হয়ে যাচ্ছি! আমরা বেকন, হ্যাজলিট, সিনেকা ও সক্রেটিসের মত দার্শনিকের কথা মত চলি না বলেই আজকের সমাজটা ক্ষয়িষ্ণুতার শেষ প্রান্তে নড়বড়ে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
লেখকঃ এ কে সরকার শাওন (কবি ও সাহিত্যিক)