রাশেদ খান মিলন
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ। পাট ও পাটজাত পন্যের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ তথা প্রায় ৭২ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। ‘সোনালী আঁশ’ এর দেশ বাংলাদেশ পাট উৎপাদনে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের পাটবীজের আমদানি নির্ভরতা কাটছে না। ২০২২-২৩ উৎপাদন বছরে ৫ হাজার টন পাটবীজ আমদানির অনুমতির বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার ১৬৬ টন। আমদানি কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম জমিতে পাট চাষ হয়েছে ঐ উৎপাদন বছরে। ২০২৩-২৪ উৎপাদন বছরে দেশে প্রায় ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, মেস্তা ও কেনাফ চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বীজের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৯ টন। ইতোমধ্যে তোষা পাটের বীজ ৪ হাজার ৬০০ টন এবং মেস্তা ও কেনাফের বীজ ৫৭৬ টন আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। পাট বীজের চাহিদার অবশিষ্ট ১ হাজার ১৯৩ টন অর্থাৎ ১৯ শতাংশ সরবরাহ করবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা উৎস। বর্তমান সরকারের দৃঢ় ও নানা কার্যকরী পদক্ষেপের ফলে দেশের অভ্যন্তরে এখন পাটবীজের উৎপাদন বাড়ছে ।
প্রকৃতপক্ষে, পাটবীজ উৎপাদনের মৌলিক ধাপ তিনটি। এগুলো হচ্ছে- প্রজনন বীজ, ভিত্তি বীজ ও প্রত্যয়িত বীজ। প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত শতভাগ কৌলিত্বাত্তিক দিক থেকে বিশুদ্ধ বীজ প্রজনন বীজ নামে পরিচিত। প্রজনন বীজকে বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ভিত্তি বীজ। সরাসরি বা গবেষণা খামারে গবেষক এবং বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়। ভিত্তিবীজ বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় প্রত্যয়িত বীজ। এই বীজই কৃষকদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি এই বীজের সনদ প্রদান করে। দেশে ২০১৭-১৮ উৎপাদন বছরে ৭ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ করা হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। তাই ২০১৭-১৮ সালের জমির পরিমাণকে ভিত্তি ধরে এখন পাটবীজের চাহিদা হিসাব করা হয়। বর্তমানে প্রতি হেক্টরে পাট চাষ করতে ৬ দশমিক ৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। এই বিপুল পরিমান উন্নত পাট বীজ উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করতে বর্তমান সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে এবং ২০২১ সালে এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এ রোডম্যাপ বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
এ রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রথম বছর ২০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। ভিত্তি বীজ উৎপাদনের জন্য পাট উৎপাদনপ্রবন এলাকায় ৩০০০ টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে ১ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। ২য় বছরেও প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে। পাশাপাশি পাট উৎপাদনপ্রবন এলাকায় ৩০০০ টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষীদের বিতরণ করা হবে।
তৃতীয় বছর বিজেআরআই এর সরবরাহকৃত প্রজনন বীজ থেকে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে ২ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইসাথে ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের বিতরণ করা হবে।
চতুর্থ বছর একইভাবে বিজেআরআই এর সরবরাহকৃত প্রজনন বীজের মাধ্যমে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে দেশের মোট চাহিদার শতভাগ প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এই বীজ ভর্তুকি মূল্যে প্রতিকেজি ১০০ টাকা দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে। এ বছরেও ৩০০০ টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম বছরে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। এ পাটবীজও ভর্তুকি মূল্যে ১০০ টাকা কেজি দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে।
কৃষকের দীর্ঘদিনের চাষাবাদের অভ্যাসের কারণে বর্তমানে বাইরে থেকে যে পাটবীজ আমদানি করা হয় তার বেশির ভাগই তোষা পাট জেআরও-৫২৪ জাতের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও সময়োপযোগী উদ্যোগে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে পাটের জীবন রহস্য উম্মোচন করেছে। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজেআরআই এর বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোষা-৮ (রবি-১) নামে পাটের একটি নতুন জাত অবমুক্ত করেছে। এর ফলন জেআরও-৫২৪ জাতের পাটের চেয়ে ১০-১৫ ভাগ বেশি।
আগে কৃষকরা পাটক্ষেতের কিছু অংশের পাট বীজ উৎপাদনের জন্য রেখে দিতেন। এই পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহে সময় লাগত ১০-১১ মাস। এ সমস্যা সমাধানে বিজেআরআই নাবি পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, এই ৪ মাসে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়াও বিজেআরআই উদ্ভাবিত ও উন্নতকৃত প্রযুক্তি – সাথী ফসল বা রিলে ক্রপিং পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, সরাসরি বীজ বপন পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, কান্ড ও ডগা রোপণ পদ্ধতিতে পাটবীজ উৎপাদন, পাট বীজের সাথে সাথী ফসল হিসেবে সবজি উৎপাদন, পাট বীজ ফসলের সাথে শাকসবজি চাষ পদ্ধতি ইত্যাদি বাংলাদেশের পাটবীজের চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। নাবি পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তিসহ অন্যান্য প্রযুক্তি সঠিকভাবে সম্প্রসারণ করা গেলে কৃষক নিজেই তার প্রয়োজনীয় পাট বীজ উৎপাদন করতে পারবে।
সর্বোপরি, বর্তমান সরকারের নানা পরিকল্পনায় ও উদ্যোগে উন্নত পাট বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই সাথে একটি আধুনিক গবেষণাগার ও বৃহৎ খামার পাটবীজ উৎপাদনে দেশকে দ্রুত স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
(লেখক: রাশেদ খান মিলন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট)