বৃক্ষ সম্ভবত মানুষের সবচেয়ে এবং একমাত্র নিঃস্বার্থ বন্ধু। প্রচণ্ড খরতাপে মায়া ভরা এক বুক ছায়া নিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে দেয় বৃক্ষ, শান্ত আর শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। ক্রমশ যতই খরতাপে আমাদের কষ্ট বাড়ছে, তার বড় কারণ অকাতরে গাছ ধ্বংস করা। উন্নয়নের নামে, সরকারি উদ্যোগ , ব্যক্তি উদ্যোগে যেভাবে গাছ ধ্বংস হচ্ছে তাতে সামনে খরতাপে নাকাল হওয়াটা বাড়বে বৈকি কমবে না। গাছের ও তো প্রাণ আছে। আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রবসুই সেটা প্রমাণ করেছেন। আরেক প্রাণী হয়ে আমরা কী করে আমাদের বৃক্ষ বন্ধুকে উজাড় করতে পারি! গাছ হয়তো তার নির্বাক কন্ঠে আমাদের কাছে তার প্রতিবাদ, আকুতি জানাতে পারে না তাই বলে কী আমরা তার অব্যক্ত কথা শুনবো না? প্রতি মুহূর্তে যে শ্বাস বুক ভরে নেয়া সে তো এই গাছ বন্ধুর কল্যাণেই।
গাছ যে আমাদেরকে কত দেয় তা জানতে আপনার বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে বা পরে না। অথচ খাবার পানি ছাড়া এর চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে বৈশ্বিক উষ্ণতায়, এল নিনো, গ্রিন হাউস ইফেক্ট, দাবানল কথাগুলো যেন ক্রমশ বেশি আতঙ্কের কারণ এমনকি পৃথিবী গ্রহে আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের আর কোন বিকল্প প্লানেট বি নেই। তাই তো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে আর ভবিষ্যত প্রজন্মকে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে হলে গাছ বন্ধুর প্রতি সদয় হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের ছায়াময় সবুজ প্রতিবেশীরা কার্বন শোষণ করে, একটি জলবায়ু পরিবর্তনকারী গ্রিনহাউস গ্যাস। এমনকি একটি ছোট চারা বাতাসকে ফিল্টার করে, কণার দূষণ গ্রহণ করে এবং জীবনদাতা অক্সিজেন ত্যাগ করে। গাছ এমনকি জিনিস ঠান্ডা করে। ইভাপোট্রান্সপিরেশন গ্রীষ্মের বাতাসকে 9.0 ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা করতে পারে। তাই গাছ লাগানোর চর্চাটা হওয়া উচিত একদম ছোট্ট বয়স থেকেই। একটা শিশু যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যত, ঠিক তেমনি একটি গাছ ঐ শিশুর প্রাণের অস্তিত্ব পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার জন্য গাছের দরকার। ছোট্ট শিশুটি বড় হবে, গাছ বন্ধুও বড় হবে। অক্সিজেন দেবে, ফুল-ফল দেবে, পাখির আবাস হবে। কত চমৎকার একটা বিষয়, কত প্রাণিকুর উপকৃত হবে! আমাদের স্কুল কলেজগুলিতে গাছ লাগানোর চর্চাটা তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। কোন এক বিশেষ দিবসে গাছ লাগানো হয় হয়তো, সেটাও খুব একটা বড় পরিসরে না। আবার গাছ লাগানো হলেও সেটার আর যত্ন নেয়া হয় না পরবর্তীতে। যত্নের অভাব পানির অভাবে গাছটি হয় মারা যায় অথবা অপুষ্টিতে বাঁচে । অথচ অনায়াসে একেকটা গাছের দায়িত্ব একেকটা শিক্ষার্থীকে দেয়া যেতে পারে। এতে যেমন গাছের প্রতি মায়াটা জন্মাবে, গাছ লাগানোর আগ্রহ বাড়বে আর গাছটা বড় হবে যত্নে। দেশের কিশোর পুনর্বাসন কেন্দ্র, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে থাকা শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে গাছ লাগানো, গাছের পরিচর্যা করা পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার একটা অংশ হতে পারে। এতে করে হয়তো অন্ধকার দিকে থেকে প্রকৃতির পরশে তারা আলোর পথের যাত্রী হবে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বই আর গাছ উপহার দেয়া হতে পারে বৃক্ষরোপণে উৎসাহী করার একটা চমৎকার উপায় ।
সম্প্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ একটি নতুন স্নাতক প্রয়োজনীয়তা প্রস্তাব করেছে – স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের আগে, অনুষদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে পাঁচটি গাছ লাগাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের 53 তম সভায় প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছে, এই অনুষদের অধীনে একমাত্র বিভাগ ইংরেজি বিভাগের স্নাতক প্রোগ্রামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্নাতক হওয়ার জন্য এই শর্তটি পূরণ করতে হবে। যদিও গাছ লাগানোর জন্য কোনো ক্রেডিট বা মার্ক বরাদ্দ না করা হয়, তবুও এই বিষয়ে বিভাগ থেকে চারা রোপণের ছাড়পত্র না পাঠানো পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশংসাপত্র অর্জন করতে পারে না। তাই বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্সের অধীনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে পাঁচটি গাছ লাগাতে হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর ক্যাম্পাস, রাস্তার ধারে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা উপযুক্ত কোনো স্থানে অন্তত ২০০টি গাছ লাগাবে। যদি কোনো শিক্ষার্থী পাঁচটি চারা কেনার সামর্থ্য না রাখে, তাহলে বিভাগের ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
মাত্র ৩৪ একরের যবিপ্রবিতে গাছের বড় অভাব। আশপাশে যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত হয় কেবল রড-সিমেন্ট-পাথরের বহুতল ভবন দৃষ্টিগোচর হয়। অক্সিজেন এর যেন বড় অভাব যবিপ্রবি ক্যাম্পাসে। পুরো ক্যাম্পাসে তেমন কোন বড় গাছ নেই যেখানে একজন পরিশ্রান্ত শিক্ষার্থী একটু ছায়া পাবে, গাছের শীতল পরশ গায়ে বুলাবে। কাঠফাটা রোদ্দুরে ছাওআ মাথায় ক্যাম্পাসে চলাচল করাটাই সূর্যের কড়া আঁচ থেকে রক্ষা পাওয়ার সমাধান । অথচ ক্যাম্পাসে যদি বড় বড় গাছ থাকতো, সবুজ হতো কতই না মনোরম পরিবেশ হতো। পাখিদের আনাগোনা বাড়তে আরো। এমন একটা ক্যাম্পাসে, গাছের প্রতি চরম নির্মমতার সময়ে ইংরেজি বিভাগের এমন একটা উদ্যোগ নিখাদ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। এমন উদ্যোগ আরো আসুক। সব ডিপার্টমেন্ট সবুজে সবুজে ভরে উঠুক। ক্যাম্পাস চিরসবুজ হোক। গাছেতে, মানুষে প্রাণে প্রাণ মিলুক। গাছের প্রতি নিষ্ঠুরতার এই সময়ে আমরা যদি গাছ লাগানোর চর্চা না করি তাহলে কীভাবে হবে?” আমরা যদি না জানি মা, কেমনে সকাল হবে?” কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো যথার্থই বলেছেন। বৃক্ষ বন্ধুকেআমরা আমরা সবাই প্রকৃতি মাতার সন্তান। কিন্তু আমরা তাকে নানাভাবে লুণ্ঠন করেছি, বাস্তুতন্ত্রকে বিঘ্নিত করেছি এবং পৃথিবীকে প্রায় বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছি। পৃথিবী বাসযোগ্য না হলে আমাদের সকল জ্ঞান ও অর্জন কোনো কাজে আসবে না। ইংরেজি বিভাগের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এটি একা সমগ্র দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে না। বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একই উদ্যোগে এগিয়ে এলে আমাদের দেশ হয়ে উঠতে পারে আরও সবুজ ও সুন্দর। জাস্ট কর্তৃক গৃহীত বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে না বরং তাদেরকে সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিকও করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশ রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক :
সামিয়া জাহান শেফা
শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগ ,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়;
গবেষণা সহকারী, বায়োইনফরমেটিক্স রিসার্চ ল্যাব, সেন্টার ফর রিসার্চ
ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরআইডি), ঢাকা।