নিশান খান
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তফশিল ঘোষণা শেষে চূড়ান্ত ভোটার তালিকাও ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী মোট ভোটার ১১,৯১৯ জন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ভোট হবে।
ক্যাম্পাসের আবাসিক হল, বিভাগগুলো থেকে শুরু করে বটতলা, ক্যাফেটেরিয়া, চৌরঙ্গী পয়েন্টসহ সব আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু এখন জাকসু নির্বাচন। এতে নির্বাচনকে ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা আসন্ন জাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের সার্বিক অধিকার আদায়ে কাজ করবেন। গত সোমবার ও মঙ্গলবার দু’দিনে জাকসুর জন্য ৮৭ জন এবং হল সংসদের জন্য ২৪১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. এ কে এম রাশিদুল আলম গত মঙ্গলবার বিকাল ৫ টায় ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এছাড়াও, ছাত্রসংগঠনগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময়সীমা বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে জাকসুকে ঘিরে শাখা ছাত্রদলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি দেখা গেছে। গত ৮ আগস্ট ১৭ টি আবাসিক হল ও শাখা কমিটি বর্ধিত করার পর নবগঠিত কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদ দেওয়ার অভিযোগে একাংশ বিক্ষোভ করেন। এরপর থেকে ওই অংশের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে নিয়মিত শোডাউন করছেন। আসন্ন নির্বাচনে ছাত্রদল থেকে দুটি প্যানেল হওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। একটি প্যানেল শাখা ছাত্রদলের সুপার ফাইভের অনুসারীদের মধ্য থেকে অন্য প্যানেল বিদ্রোহী গ্রুপ থেকে হতে পারে বলে ছাত্রদলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। বিদ্রোহী গ্রপের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক-সদস্য সচিবসহ সুপার ফাইভের নেতাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, ‘জাকসুতে ছাত্রদলের আলাদা প্যানেল থাকবে। আমরা সেই লক্ষ নিয়েই কাজ করছি। দলের সবার সঙ্গে আলোচনার করছি। তফশিল অনুযায়ী ২৫ তারিখে খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর জাকসু ও হল সংসদের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করব। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের সার্বিকভাবে পরামর্শ দিয়েছেন।’
প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত দুটি প্যানেল হওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। একটি প্যানেলে থাকতে পারে ছাত্র ইউনিয়ন একাংশ (অদ্রি-অর্ক), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (ফাইজা), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ কয়েকটি সমমনা সাংস্কৃতিক সংগঠন। অন্য প্যানেলে থাকছে ছাত্র ইউনিয়নের অপর অংশ (জাহিদ-তানজিম), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (মেঘ), জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার।
এছাড়া ৩৬ বছর পর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে ছাত্রশিবির। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেনি। সংগঠনটির দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একক প্যানেল রেডি আছে। তবে অনেকের সঙ্গেই এখনও আমাদের আলোচনা চলমান রয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা শেষে আমরা আমাদের প্যানেল ঘোষণা করব। এবারের জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ছাত্রসংগঠন হিসেবে নির্বাচন করছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। এককভাবে প্যানেল ঘোষণা করতে চায় সংগঠনটি। সংগঠনটির জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি এককভাবে প্যানেল ঘোষণা করতে। তবে আমরা আলোচনার সুযোগ রেখেছি। আমাদের সংগঠনের বাইরেও দীর্ঘদিন যারা শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে কাজ করেছেন তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলমান রয়েছে।’ শোনা যাচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানে অবদান রাখা আবদুর রশিদ জিতু এবং ছাত্র ফ্রন্টের জাবি শাখার সংগঠক সোহাগী সামিয়া পৃথক প্যানেল নিয়ে জাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। যদি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীতা ঘোষণা করে, তবে নির্বাচনের সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করছে অনেকে।এছাড়াও জাকসুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মতাদর্শের বেশকিছু প্রার্থীরা প্যানেলের বাইরে গিয়ে ‘স্বতন্ত্র’ নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে সাত দফা নির্দেশনা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে—
১. একজন প্রার্থী একাধিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
২. প্রতিটি মনোনয়নপত্রে একজন প্রস্তাবক ও একজন সমর্থকের স্বাক্ষর, শিক্ষাবর্ষ ও বিভাগ উল্লেখ করতে হবে।
৩. একই ব্যক্তি একাধিক প্রার্থীর প্রস্তাবক বা সমর্থক হতে পারবেন না (কার্যকরী সদস্য পদ ছাড়া)। কার্যকরী সদস্য পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছয়জনের (তিনজন নারী, তিনজন পুরুষ) প্রস্তাবক বা সমর্থক হওয়া যাবে।
৪. মনোনয়ন জমার সময় শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র বা ছবিযুক্ত লাইব্রেরি কার্ড অথবা ইনডেক্স কার্ড প্রদর্শন করতে হবে।
৫. প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে সব পাওনা পরিশোধের প্রমাণ দিতে হবে।
৬. মনোনয়নপত্রের সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজের সদ্য তোলা রঙিন ছবি জমা দিতে হবে (দুই মাসের বেশি পুরোনো ছবি গ্রহণযোগ্য নয়)।
৭. প্রতিটি হলে মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও জমাদানের জন্য পৃথক রেজিস্ট্রার খাতা সংরক্ষণ করতে হবে।
মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এবিএম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসে সব ধরনের অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, কর্মসূচি, মোটরসাইকেল চলাচল এবং ২৫ জনের অধিক জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, ‘নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে আমরা সতর্ক রয়েছি। নির্বাচনে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এজন্য সকল অংশীজনের সহযোগিতা কামনা করছি।’