মোজাম্মেল পাঠান :
মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, ন্যায়- সত্য- অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কোন আত্মত্যাগ রক্তদান বৃথা যায় না।নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য প্রথমেই ছাত্র সমাজই বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।সে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আজকের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকরাই প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল ছাত্ররাই।১৯৮৩ ইং সনের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে ছাত্ররাই এরশাদের সামরিক আইন ভঙ্গ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে সেলিম, দেলোয়ার, দীপালী সাহা, নুর হোসেন সহ আরো অনেক বীর শহীদদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়ে গণতন্ত্রের নবীন যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিয়তির নির্মম পরিহাস কালের পরিক্রমায় দলবাজি দূর্নীতি আধিপত্যবাদ কায়েম করতে গিয়ে গণতন্ত্র আজ স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়।দেশে দুর্নীতির মহাউৎসব চলছিল। কন্ঠরুদ্ধ মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রেই যায় না। ভোটের নামে প্রহসন, দিনের ভোট রাতে, বিনা ভোটে নির্বাচিত, আমি ও ডামির নির্বাচন। জনপ্রতিনিধিরা এক আঙুলির নির্দেশে নির্বাচিত হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনমানে নাভিশ্বাস, মূল্যস্ফীতি দুবছর ধরে বেড়েই চলেছে লাগাম টানা যাচ্ছে না।বিদেশে অবৈধ ভাবে টাকা পাচারের প্রতিযোগিতা চলছে। দেদারছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংক ফুটো করে দিচ্ছে।এসব দুর্নীতির তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এই গণঅভ্যুত্থান। বেশিদিন আগের কথা নয় অকুতোভয় ছাত্ররাই গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠিত করে ৭১ এর যুদ্ধ পরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করেছিল। নিরাপদ সড়ক দাবিতে কোমলমতি ছাত্ররাই রাস্তাই নেমেছিল। ২০১৮ সালে ছাত্ররাই প্রথম কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেছিল।তাদের দাবির মুখে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়।একথা অনস্বীকার্য যে দেশের প্রতিটি ঐতিহাসিক ও ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সম্মুখযুদ্ধার ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি আদালতের রায়ের সুত্র ধরে সরকার যখন পূর্বের কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার পায়তারা শুরু করে তখনই বাংলার চির-বিদ্রোহী সাধারণ ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। তখন এক অভূতপূর্ব দ্রোহের সৃষ্টি হলো।শুরু থেকেই ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছিল।দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা গুরুত্ব দেন নাই বরং উপহাস তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যাচ্ছিলেন,ওদিকে আন্দোলন দিন দিন শক্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে।সেই আবার পুরনো খোঁটা যেকোন পরিস্থিতি শাসকদলের বিপক্ষে গেলে সকলকে রাজাকার তকমা দেওয়া।এটা যেন একটা রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। শাসকদল আওয়ামিলীগের সাধারণ সম্পাদকের উস্কানিতে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করা শুরু করলো পুলিশও যখন গুলি চালিয়ে তাদের চোখের সামনে তাদেরই সহপাঠীদের হত্যা করলো তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আর সহ্য করলো না, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো। সংবাদে দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহ দেশের সকল সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পুলিশের সাথে এবং ক্ষমতাসীন দলের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডাবাহিনীদের প্রতিহত করতে তাঁদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এমন কি প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করতেছে না। এরমধ্যে অনেক মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেল।পুলিশের সামনে বুক এগিয়ে দেওয়া বেরোবি’র ছাত্র আবু সাঈদের বুকে পুলিশ গুলি চালিয়ে দিলো।স্বাধীন দেশে এ কি দেখলাম। এটি খুবই হৃদয়স্পর্শী লোমহর্ষক ঘটনা যা খুবই অগ্রহণযোগ্য ও সম্পুর্ন বেআইনি। এ নির্মম হত্যাকান্ড দেখে ছাত্ররা কি আর ঘরে বসে থাকতে পারে।বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজপথে এত ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। শাসকদল কোন মতে ছাত্র হত্যার দায় এরাতে পারে না।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে পড়েছি ঢাকার রাজপথ রফিক, বরকত,সালাম, জব্বার সহ অনেক শহীদের রক্তে রঞ্জিত তখন দলমত নির্বিশেষে ছাত্র জনতা ও দেশবাসী সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজও সেই অবস্থা দেখা গেছে। এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরুণ বয়সে আমাদেরও রক্ত ঝরে ছিল রাজপথে। জুলুম অবিচার দেখলে এখনও রক্তে শিহরণ জাগে। ইতিহাসের শিক্ষা ছাত্ররা পরাভব মানে না।ছাত্র জনতার এই বিদ্রোহ রুখিবার সাধ্য কারো নাই। ২০২৪ এ জুলাইয়ে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘদিনের শোষণ, দুর্নীতি, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটার একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। জনতাকে উপেক্ষা করে কোন শাসকেই টিকে থাকতে পারে না। এই রক্তসিক্ত গণঅভ্যুত্থান থেকে সকল শাসকরাই শিক্ষা নেওয়া জরুরি। অনেক অশ্রুসিক্ত নয়নে, বেদনা ভরা ভারাক্রান্ত মনে এই গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনের প্রথম শহীদ ও এই প্রজন্মের নতুন বীর আবু সাঈদ সহ আরও অজানা বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
অগনিত আহতদের সুস্থতা কামনা করি শহীদদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।সংগ্রামী বীর ছাত্রদের প্রতি জানাই লাল সালাম।বৈষম্যহীন, শ্রেনীবৈষম্য সমাজ বদলের সংগ্রামে তোমরা এগিয়ে যাও। বিজয় অবশ্যম্ভাবী।