জনগণ প্রশাসনের কাছ থেকে উন্নতমানের নাগরিক সেবা চায়। অফিসারদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার চায়। জনগণ অফিস আদালতে হয়রানি চায় না। সেবাটা দ্রত পেতে চায়। বাংলাদেশের অফিস আদালতকে এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে অফিসে গেলে তাদের মধ্যে এই উপলব্ধি হয় যে তারা এ দেশের মালিক এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক। প্রত্যেক অফিস বা আদালতে জনগণের সস্তুষ্টি অথবা অসন্তুষ্টি পরিমাপ করার ডিজিটাল মেশিন রাখতে হবে। এটি পারফর্মেন্স রেকর্ড হিসেবে অফিসারদের আমলনামায় প্রতিনিয়ত যোগ হবে। সংবিধানে বলা আছে একজন সরকারী কর্মচারী সর্বদা জনসেবায় সচেষ্ট থাকবে। এ সাংবিধানিক নসিহতকে আমাদের দেশের অফিস আদালত খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেননা এর মধ্যে সাংবিধানিক কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বা এটি মানবাধিকার আদালতের মাধ্যমে বলবৎ যোগ্য নয়। সংবিধানে মানবাধিকারের ক্যানভাসটা আরো অনেক বড় করতে হবে এবং সেগুলো মানবাধিকার আদালতের মাধ্যমে আদায়যোগ্য করতে হবে। ভাল নাগরিক সেবা দিয়ে একজন ভাল অফিসারের কপালে পদোন্নতি জুটবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। নাগরিক সেবা না দিলে ও কারো পদোন্নতি আটকায় না। দুর্নীতি দমন বিভাগ এবং তথ্য কমিশন প্রতিটি অফিস এবং আদালতে নাগরিক সেবার মান উন্নত করার জন্য এক সাথে কাজ করতে পারে। এজন্য তারা প্রতি মাসে নিয়মিত সভা করতে পারে। অফিসে সেবা এবং আদালতে মামলা ঝুলিয়ে রাখার মন্দ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হতে হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিকানা এবং রাষ্ট্রের মালিকানার মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। অফিসগুলো যেনো ঔপনিবেশিক ক্ষমতা বা জনগণকে ভয়ভীতি দেখানোর জায়গা না হয়। এগুলো যেনো হয় নাগরিক সেবা বিতরণ কেন্দ্র। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে অফিসের সামনে শুধু সিটিজেন চার্টার ঝুলিয়ে এবং এ পি এ সই করে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে না। অফিসের পিওন থেকে শুরু করে বস পর্যন্ত সবাই যেনো সেবা দেয়ার জন্য উন্মুখ থাকে। অফিসআদালতে এ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে নতুন নতুন মানবাধিকার সন্নিবেশ করতে হবে। অধিকারহীন মানুষ ক্রীতদাসের চেয়ে ও অধ্ম। মানুষের নাগরিক মর্যাদা সমুন্নত করতে হলে জেলায় জেলায় মানবাধিকার আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যথার্থ সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সেবা একটা ভেন্যু থেকে দেয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে। এতে করে নাগরিক ভোগান্তি বহুলাংশে লাঘব হয়। ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। একটা পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের জন্য সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে ছাত্রদের অনেক সুবিধা হয়। সংবিধানে ছাত্র শিক্ষকদের বিশেষ কিছু অধিকার রাখার কথা ভাবতে হবে। সকল সরকারি নিয়োগ পদোন্নতি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের হাতে রাখাই অধিকতর সমীচীন। এতে নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ অনেক কমে যাবে এবং দিন শেষে ছাত্ররাই বেশি উপকৃত হবে। তাদের ভোগান্তি এবং খরচ অনেকটা কমবে। কোটি কোটি শিক্ষিত বেকারের দেশে চাকুরিতে ঢুকার নির্ধারিত কোনো বয়সীমা থাকা সমীচীন নয়। কেননা আমাদের দেশে কর্পোরেট চাকুরির সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে। উচ্চ তহবিল খরচ এবং উচ্চ কর্পোরেট কর হারের কারণে ব্যবসায়ীরা এদেশে কোম্পানি খুলতে অনাগ্রহী। আবার কোম্পানি খুললে কর ফাঁকি দেয়াও খুব কঠিন হয়ে যায়। এ দেশে ব্যবসা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ গ্লোবাল রাংকিং অনুযায়ী অনেক খারাপ। এ পরিবেশ ভাল করার জন্য একসাধে কাজ করতে হবে।
নাগরিক সেবাকে সহজ এবং সুলভ করতে হলে প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য ব্যাপক আকারে প্রশাসনিক সংস্কারের প্রয়োজন হবে। এ সংস্কারে প্রচন্ড বাধা হতে পারে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল। নাগরিকস্বার্থে বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ক্যাডার সংখ্যা কমাতে হবে। প্রার্থী বাছাই কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে গবেষণার মাত্রা এবং পরিধি অনেক অনেক গুণ বাড়াতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদকে ও সংস্কার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।হয়রানি মুক্ত সেবা প্রদানের জন্য দিনরাত গবেষণায় লিপ্ত থাকতে হবে। অহেতুক বিলম্ব যথাসম্ভব রোধ করতে হবে। সরকার নাগরিকদের কোন কোন সেবা নিজে দিবে এবং কোন কোন সেবা প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে দিবে তার জন্য একটা মাষ্টার প্ল্যান দরকার। সেবা যত সহজ এবং সুলভ হবে সরকার তত জনপ্রিয় এবং জনবান্ধব হবে।সেবাগুলো সহজ এবং সুলভ করার জন্য জনগণের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের ও মতামত গ্রহণ করতে হবে।
গণ সমস্যা সমাধানে জনপ্রশাসনের সক্ষমতা কতটুকু ? একজন আমলাকে শুধু দেশের বিদ্যমান সকল আইন এবং পলিসি সম্পর্কে ভাল ধারণা অর্জন করলেই চলবে না। অন্যান্য দেশের আইন ও পলিসি সম্পর্কেও তাঁর ভাল ধারণা থাকতে হবে যাতে তিনি সরকারকে ভাল আইন এবং পলিসি সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন।পরামর্শ গ্রহণ বর্জন সরকারের এখতিয়ার। প্রশ্ন হল যদি আমলাদের ভাল পরামর্শ সরকার গ্রহণ না করে তাহলে আমলাদের করণীয় কী?কিছুই করণীয় নেই।এজন্য আমলাদের গোপন চারিতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। আইন ও পলিসি তৈরী করার সময় বিভিন্ন অংশীজনদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে এবং সাক্ষী রাখতে হবে ।সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাংবাদিকদের এড়িয়ে না গিয়ে সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে। জনগণকে অন্ধকারে রেখে কাজ করলে আমলাদের কোনো লাভ নেই। সিভিল সার্ভিস সমিতি গুলোর স্বকীয়তা, ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র না থাকলে কোটারি আমলা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের লাভ। আমলাদের পেশাগত সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জনগণ অবহিত নয়।এজন্য আমলাতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একটা ভুল বুঝাবুঝি বা ভুল বার্তা আছে।আমলাতন্ত্রের ভাবমূর্তি গঠন এবং রক্ষার দায়িত্ব অন্য কোনো পেশাজীবীর নয়। এটা কোটারি আমলাদের এজেণ্ডাও নয়। জার্মানে সিভিল সার্ভিসের কোনো অবসর বিধান নেই। ইটালিতে লিয়েন নিয়ে আমলারা পাঁচ বছর প্রাইভেট সেক্টরে চাকুরি করার সুযোগ পায়।পৃথিবীর আমলাতন্ত্র সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করার জন্য ইটালির পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন স্কুলের মত সিভিল সার্ভিস ইউনিভার্সিটির বিকল্প নেই।ইউরোপের প্রায় সকল দেশে পেশাগত সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য সিভিল সার্ভেণ্টদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আছে।সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য সুরক্ষা আইন আছে।অবসর প্রাপ্ত আমলাগণ এসব নিয়ে লেখালেখি করতে পারেন। আমলাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাথে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে হবে এবং একসাথে সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে গবেষণা করার সংস্কৃতি চালু করতে হবে।